শালতলে বেলা ডুবিল
কী দিয়ে যে লেখাটা শুরু করি. যখন একটি সাত বছরের সবুজ মন পুরুলিয়ার কোন এক অখ্যাত অজ্ঞাত স্টেশনে নেমে লরিতে চেপে বাবা কাকাদের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল অযোধ্যা
পাহাড়ে. নাকি আরো বছর পাঁচ ছয় বাদে যখন সে রুকস্যাক
পিঠে নিয়ে পৌঁছেছিল বাঘমুন্ডি বা শিরকাবাদের ক্যাম্পিং
গ্রাউন্ডে. ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখে ট্রেনের জানলায় নাক
ঠেকিয়ে দেখেছিল সূর্যের প্রথম আলোয় মায়াময় রুক্ষ
ঢেউ খেলানো পৃথিবীকে. শীতের ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায়
প্রাণে পুলক লেগেছিল, চোখে ঘনিয়েছিল ঘোর. মহুয়ার মাদকতার মতোই সে নেশা রক্তে সঞ্চারিত হয়েছিল, কোন এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়েছিল কোন এক ব্যাকুল প্রাণকে. যে অমোঘ টানে বহু বছর পরে কর্মসূত্রে ফিরে এসেও মনে হয়েছিল, কোথাও তো যাই নি আমি, এই তো সবই সুস্পষ্ট
রকম চেনা, যেন সবেমাত্র গতকালের কথা.
১৯৮৭ সালের হাল্কা শীতে প্রথমবার পুরুলিয়ায় এসেছিলাম.বাবার পাহাড়ের ক্লাবের এ.জি.এম অযোধ্যা পাহাড়ে. তখন সদ্য নবীন প্রাণে
বিভূতিভূষণের স্নেহস্পর্শ লেগেছে .আম আটির ভেঁপু চোখে মায়া অঞ্জন
পরাচ্ছে, অপরাজিত করে তুলছে ভাববিহ্বল. বরাভুম স্টেশনে ভোরবেলা ট্রেন থেকে নেমে উঠেছি ময়লা ফেলার ডাম্পারে.
সে এক অদ্ভুত মজার ব্যাপার.এক বাড়ির বারান্দার পাঁচিলে কোন দাঁড়িয়ে ডাম্পারের কাত হয়ে আসা অংশে ডিঙ্গি মেরে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেতে হবে
ওপরের দিকে. তারপর সেই ডাম্পার আস্তে আস্তে সোজা হয়ে আসবে, আর নাগরদোলায় চড়ার
মতো মেঝে আঁকড়ে বসে থাকতে হবে যতক্ষণ না সে সোজা হয়.আমার প্রথমবারের পুরুলিয়ার
স্মৃতি এইরকমই শরত কালের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো.অল্পস্বল্প মনে আছে, খোলা গাড়িতে
যেতে যেতে প্রায়শই গাছের ডাল থেকে মাথা বাচানো, আর গাড়ি অযোধ্যায় ওঠার সময়
ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় সর্বাঙ্গ মাখামাখি হয়ে যাওয়ার কথা.আবছা মনে আছে
ইউথ হোস্টেলের সামনের মাঠে তিন কিশোরের ব্যাট বল খেলা, আর তাকে ঘিরে তুচ্ছ সাময়িক
বিবাদের কথা.বাকি সবকিছু বিস্মৃতির ব্ল্যাক হোলে চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গেছে.
পুরুলিয়াকে ভালোবাসলাম ইউথ হোস্টেলের ক্যাম্প করতে এসে.দশ বছর বয়স থেকে যে নধর
চিকন ছেলেটিকে তার মুগ্ধ জননীর আঁচল থেকে বছরে দিন সাতেকের জন্য আডভেন্চরমুখী
করে তোলার প্রয়াস তার বাবা নিয়েছিলেন, ততদিন তা পাকাপাকি ভাবে শিকড় গেড়েছে. পাহাড়ে
হাঁটার প্রাথমিক পাঠ টুকু সাঙ্গ হয়েছে সান্দাকফু বা হর-কী-দুনে. এখন সদ্য শিঙ ওঠা হরিণছানার
মতো সে ব্যাকুল উপল বন্ধুর পথে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে. ইউথ হোস্টেলের ক্যাম্পে ফল ইনের লাইনে
দাঁড়িয়ে তাই সে ছটফট করে, কখন সে পাহাড়ের গা বেয়ে হ্যাচোর প্যাচোর করে উঠবে,কখনই বা
চোরকাঁটার খোঁচা খেয়ে কোমরের দড়িতে বেঁধে নামিয়ে আনবে সন্ধের ক্যাম্প ফায়ারের জন্যে ফায়ার
উডের বোঝা. জঙ্গলের পথ বেয়ে হঠাত মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা স্বতঃস্ফূর্ত বামনি ঝোরার দিকে.
শাল, মহুয়া,পলাশ, কুর্চির পাঠ নিতে নিতে প্রতিনিয়ত জারিত হওয়া এক আশ্চর্য রকম মুগ্ধ বোধে.
ততদিনে বনের সোদালি গন্ধ নিশির ডাকের মতো হাতছানি দিয়েছে. ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের সামনে
গোল হয়ে বসা দীপ্ত মুখগুলো মেতে উঠেছে হানড্রেদ মাইলস বা পথের প্রান্তে কোন সুদুর গাঁয়ের সুরে.
বাঘমুন্ডির কিশোর ভারতী আশ্রম বিদ্যালয়ের আবাসিক ছেলেরা সন্ধের আধো অন্ধকারে শুনিয়েছে
তাদের খালি গলায় প্রার্থনা সঙ্গীত "আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ ......"
সেই যে ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়,তার রেশ আজো রয়ে গেছে. পূর্বজন্মের স্মৃতির
মতোই মেদুর হয়ে ফিরে ফিরে আসে আশ্রমের ছেলেদের ছৌ নাচের ছবি,শিরকাবাদের বান্দু নদীর
ধারে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রি বাসের ছবি. আজো কাজের ফাঁকে মন ছুটে যায় মুরগুমা, চরিদা কিংবা
বান্দোয়ানের পাহাড় তলিতে. কৌতুহলী বিস্ময়ে গাম্ভীর্যের পর্দা সরিয়ে সামনে চলে আসে সেই সব স্মৃতি,
যার টানে ফিরে ফিরে দেখি এই লালমাটি শালবনের দেশটাকে. কর্মজীবনের মনখারাপ গুলো নিমেষে
মিলিয়ে যায় পাহাড়ি পথের বাঁকের ইশারায়, পলাশের লালিমায়. অস্তগামী সূর্যের আলোয় পোড়ামাটির জীর্ণ
মন্দিরগাত্রের মায়াময়তার মাঝে সন্ধে নামে. রাখIল বালকের তাড়নায় দ্রুত ফেরা গরুর পায়ের ছন্দে আলোয়
ধুলোয় মেশে রুক্ষ প্রকৃতি. সমস্ত চরাচর যেন এক বিষাদের সুরে বেজে ওঠে. শালতলে বেলা ডুবিল........